পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে চলল গেরুয়া বুলডোজার, বাংলায় কথা বলায় ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহ!

শেয়ার করুন

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা: হরিয়ানায় থাকা বাংলার প্রায় তিনশো পরিযায়ী শ্রমিকের বাড়ি ভেঙে দিল প্রশাসন। বাংলা ভাষায় কথা বলায় ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহ বুলডোজার চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ। জানা গিয়েছে, বুলডোজার চালানোর আগে তাদের আগাম কোনও নোটিস দেওয়া হয়নি। চার-পাঁচ গাড়ি পুলিশ গিয়ে গোটা বস্তি ঘিরে ফেলে নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে হরিয়ানার গুরুগ্রাম জেলার সদর থানার ঝাড়শা গ্রামের সেক্টর-৩৯ এলাকায়।

এক পরিযায়ী শ্রমিক বলেন, ‘ঈদকে সামনে রেখে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে সপরিবারে আনন্দ করব। কিন্তু মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হল ঈদের আনন্দ সঙ্গে বাড়ি ফেরার আশা। বুলডোজ দিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়ায় ক’দিন থেকে বৌ-বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় রয়েছি।’

সূত্রের খবর, প্রায় দশ বছরের বেশি সময় ধরে হরিয়ানার গুরুগ্রাম জেলায় থাকেন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় তিনশো পরিযায়ী শ্রমিক। সেক্টর-৩৯ এর একটি ফাঁকা জায়গায় টিন দিয়ে অস্থায়ী বাড়ি তৈরি করেছিলেন তারা। নদীয়া, মালদা ও মুর্শিদাবাদসহ অন্যান্য জেলার শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে সেই অস্থায়ী ঘরেই থাকতেন। কিন্তু হটাৎ তাদের উপর নেমে এলো স্থানীয় প্রশাসনের আক্রোশ।

২৪ মার্চ, সোমবার স্থানীয় প্রশাসন বুলডোজার নিয়ে হাজির হয় ওই বস্তিতে। দ্রুত এলাকা খালি করতে বলা হয় তাদের। ঠিক কি কারণে প্রশাসনের এই নির্দেশ! বুঝে ওঠার আগেই বুলডোজার চালিয়ে দেওয়া হয় ওই বস্ততিতে। ভেঙে ফেলা হয় প্রায় তিনশো অস্থায়ী বাড়ি।

সামাদ শেখ নামের এক পরিযায়ী শ্রমিক জানান, চার-পাঁচ গাড়ি পুলিশ এসে ১০ মিনিটের মধ্যে ঘর খালি করতে বলেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা কিছুই জানায়নি। আমরা একদিন সময় চেয়েছি, সেটুকু দেওয়া হয়নি। বুলডোজার চালিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সব ভেঙে ফেলা হয়।

(প্রশাসনের উপস্থিতিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় বুলডোজার। || Pic: Special Arrangement)

বহু শ্রমিককের অভিযোগ, ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে বুলডোজার চালিয়ে সব ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যটিতে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে বাঙালি বিদ্বেষ মাথা চাড়া দিয়েছে। এখানে বাংলায় কথা বলাও অপরাধ। বাংলাদেশি তকমা দিয়ে হেনস্থা করা হয়।

নদীয়া, মালদা ও মুর্শিদাবাদসহ অন্যান্য জেলার বহু শ্রমিক ওই রাজ্যে বিভিন্ন রকমের কাজ করেন। কেউ রিকশা চালান, কেউ ফেরি করেন, কেউ কলকারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। মহিলারা বাড়িতে বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। জানা গিয়েছে, সংসারে অভাবের কারণে রাস্তায় বসার অবস্থা হয়েছিল মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গার সুরুলিয়ার বাসিন্দা নুর ইসলামের। বিগত ছ’মাস আগে স্ত্রী, সন্তান-সহ পরিবারের ১০ জনকে নিয়ে গুরুগ্রামে কাজে যান নুর।

তার স্ত্রী আমিনা খাতুন জানান, “ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছিলাম। এলাকায় তেমন কাজ হচ্ছিল না। সংসারে অভাব মেটাতে বাধ্য হয়ে ভিন রাজ্যে কাজে এসেছি।”

গুরুগ্রাম জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ওই বস্তির জায়গাটি সরকারি। অবৈধভাবে দখল করে সেখানে বসতি এবং ঘর তৈরি করা হয়েছে। ঘর ভাঙার আগে সেখানে বসবাসকারীদের জায়গা খালি করতে বলা হয়েছিল। এলাকায় মাইকিংও করা হয়। কোর্টের নির্দেশে সেক্টর-৩৯ এর বস্তি ভেঙে ফেলা হয়েছে। যদিও পরিযায়ী শ্রমিকদের দাবি, আগাম তাদের কোনও নোটিস দেওয়া হয়নি। বস্তি আসলে বাংলাদেশিদের আখড়া বলেই ভেঙে ফেলা হয়েছে।

(বুলডোজার দিয়ে ঘর ভেঙে ফেলায় অসহায় শ্রমিকরা || Pic: Special Arrangement)

দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে গুরুগ্রামে কাজ করেন নদীয়ার পলাশির পলসন্ডার মুকুল হাসান। তিনি বলেন, যে জায়গাটিতে আমরা থাকি সেটি স্থানীয় এক ব্যক্তির। জমির মালিক আমাদের থেকে মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে থাকতে দিয়েছেন। আমরা বাইরে থেকে এখানে কাজ করতে এসেছি। কারো জায়গা অবৈধভাবে দখল করতে যাবো কেনো? কি কারণে বাড়ি-ঘর ভাঙা হল জানিনা। আমাদের কিছু বলা হয়নি।

পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি আসিফ ফারুক জানান, দেশের সর্বত্র বাংলার শ্রমিকরা নানা ভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে বাংলায় কথা বলায় ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার নতুন খেলা শুরু হয়েছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে সবচেয়ে বেশি হামলা হচ্ছে শ্রমিকদের উপর।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, “ঘটনার দিন থেকে লাগাতার শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তাদের সব রকমের সহযোগিতা করা হচ্ছে। শ্রমিকদের বাংলায় ফিরে আসতে বলা হয়েছে। রাজ্য সরকারের তরফে তাদের কাজের ব্যবস্থা করা হবে।” তৃণমূল মুখপাত্র জয়প্রকাশ মজুমদার বলেছেন, “বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিই। তারপর মন্তব্য করব।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *