নয়াদিল্লি: দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা ভোট হয় বিভিন্ন সময়ে। আবার কেন্দ্রীয় সরকারের মেয়াদ শেষ হলে, লোকসভা ভোট! এই ব্যবস্থাটিকে এবার বদলে ফেলতে চাইছে মোদি সরকার। ‘এক দেশ এক ভোট‘ প্রস্তাবে সায় দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। এরপর মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) লোকসভায় এই সংক্রান্ত বিল পেশ করেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়াল। ‘এক দেশ এক ভোট’ বিল পেশ নিয়ে মঙ্গলবার ভোটাভুটি হয় লোকসভায়। বিলের পক্ষে ভোট দেন সরকার পক্ষের ২৬৯ জন সাংসদ। বিপক্ষে ১৯৮ জন। ভোটাভুটিতে কেন্দ্রের পক্ষে বেশি ভোট পড়লেও বিলটি পাস করানো যায়নি। কারণ, সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করতে গেলে সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। এখন সংসদের উভয় কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ এনডিএ-ই। কিন্তু রাজ্যসভা, এমনকী লোকসভাতেও তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মঙ্গলবার জানান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘এক দেশ এক ভোট’ বিলের খসড়া নিয়ে সংসদের যৌথ কমিটিতে আলোচনা চান। বিরোধী সাংসদদের বক্তব্য, এই বিল সংবিধানের মূল কাঠামোতেই আঘাত হানবে। এর মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র কায়েম করার চেষ্টা হচ্ছে। বিলের তীব্র বিরোধিতা করেছে কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি-সহ বিরোধীরা।
‘এক দেশ এক ভোট’ নিয়ে কেন্দ্রের যুক্তি:
প্রথমত, এই নিয়ম চালু হলে কমবে নির্বাচনের খরচ। প্রতি নির্বাচনে বিপুল টাকা ব্যয়ের বোঝা হালকা হবে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে খরচ হয়েছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিটি রাজ্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে। যদি এক দেশ এক নির্বাচন ব্যবস্থা হয় তবে এই খরচ অনেকটাই কমবে বলে আশাবাদী কেন্দ্র।
দ্বিতীয়ত, এক দেশ এক ভোট হলে প্রশাসনিক দক্ষতা ও কার্যক্ষমতাও অনেকাংশে বাড়বে। লোকসভা বা বিধানসভা প্রতিটি নির্বাচনের সময়ে বহু সরকারি কর্মীকে কাজে লাগানো হয়। এতে প্রভাব পড়ে প্রশাসনিক কাজে। যদি একই সময়ে নির্বাচন হয়, তবে প্রশাসনিক কাজে প্রভাব কম পড়বে। লোকবল ও সময় বাঁচবে।
তৃতীয়ত, প্রতিটি নির্বাচনের আগেই লাগু হয় আদর্শ নির্বাচনী আচরণ বিধি। এর ফলে ঘোষণা করা যায় না নতুন কোনও সরকারি প্রকল্প। যদি এক সময়ে গোটা দেশে নির্বাচন হয়, তবে বিভিন্ন সময়ে নতুন প্রকল্প চালু করার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা তৈরি হবে না। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতি এবং কর্মসূচির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও এই নীতি সহায়ক হবে।
চতুর্থত, বিলের সমর্থনে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের দাবি, গোটা দেশে একসঙ্গে নির্বাচন হলে ভোটারদের মধ্যে তার ভালো প্রভাবই পড়বে। সকলে একসঙ্গে ভোট দেবেন। এতে বাড়বে ভোটের হারও।
এক দেশ এক ভোটের সমস্যাগুলি কী কী:
প্রথমত, প্রথম প্রতিবন্ধকতা হলো সংবিধান সংশোধন। রাজ্যের বিধানসভা ও লোকসভার মেয়াদকে একই সময়ের মধ্যে বাঁধতে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন করতে হলে বদল আনতে হবে সংবিধানেও। পাশাপাশি পরিবর্তন করতে হবে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন এবং সংসদের কার্যপ্রণালীতেও।
দ্বিতীয়ত, এক দেশ এক ভোটের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলির সব থেকে বড় চিন্তা হলো, তারা আঞ্চলিক সমস্যাগুলিকে তুলে ধরতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় ইস্যুগুলিই গুরুত্ব পাবে প্রচারে। নির্বাচনী পরিকল্পনাতেও সমস্যা তৈরি হবে। আঞ্চলিক দলগুলির পুঁজিও কম। তাই সেক্ষেত্রে জাতীয় স্তরের দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রচার বা খরচ করাও সম্ভব হবে না আঞ্চলিক দলগুলির পক্ষে।
তৃতীয়ত, একই সময় রাজ্য ও কেন্দ্রের ভোট হলে প্রভাবিত হতে পারেন ভোটাররা। এ নিয়ে ২০১৫ সালে একটি সমীক্ষা হয়েছিল। সেই সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, একই সময়ে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হলে, ৭৭ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে ভোটাররা একই দলকে দুই নির্বাচনে সমর্থন করবেন। তার বদলে যদি ছয় মাসের ব্যবধানে দুই নির্বাচন হয়, তবে ৬১ শতাংশ ভোটাররা বেছে নিতে পারে আলাদা আলাদা দলকে।
প্রসঙ্গত, সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের মাঝেই গত ১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘এক দেশ এক ভোট’ সংক্রান্ত কমিটির রিপোর্ট অনুমোদিত হয়েছিল। ‘এক দেশ এক ভোট’ কার্যকরের দিশানির্দেশিকা খুঁজতে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর কোবিন্দের নেতৃত্বে কমিটি গড়েছিল মোদি সরকার। লোকসভা ভোটের আগেই গত ১৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে গিয়ে একসঙ্গে লোকসভা এবং সব ক’টি বিধানসভার নির্বাচন করানোর সুপারিশ করা হয়। আট খণ্ডে বিভক্ত ১৮ হাজার পাতার রিপোর্টও জমা দিয়েছিল কোবিন্দ কমিটি। সেখানে হাজির ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ কমিটির অন্য সদস্যরা। এদিকে রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভার স্পিকারদের সঙ্গে আলোচনা করে, বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ এবং জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মতামত নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর পরিকল্পনা করছে কেন্দ্র। এর পর বিল পাশ হলে পৌঁছবে রাজ্যসভায়। সেখানে পাশ হলে সই করবেন রাষ্ট্রপতি। তবে সেটি পরিণত হবে আইনে।