প্রীতম ঘোষ
কোন জাতিকে ধ্বংস করার জন্য গুলি-বন্দুক দরকার হয় না, তার শিক্ষা পরিকাঠামোর কোমর ভেঙে দিলেই হয়। আজ আমাদের পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতবর্ষের সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থার তেমনই কোমর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আমাদের রাজ্যে সেই কোমর ভাঙার প্রথম কাজটি শুরু করেছিলেন তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার ১৯৮৪ সালে, প্রাথমিক স্তরে পাশ-ফেল প্রথা তুলে দিয়ে মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে। তারপর শিক্ষার অধিকার আইন ২০১০-এ ‘সবার জন্য শিক্ষা’র অজুহাতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দিয়ে সেই কোমর ভাঙার কাজটি সুসম্পন্ন করলেন কংগ্রেস শাসনাধীন তৎকালীন কেন্দ্র সরকার। সবার শিক্ষা তো হলোই না, বরং অশিক্ষা ও অজ্ঞানতা গ্রাস করলো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রারম্ভিক শিক্ষার্থীদের। সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দেওয়া হলো। গোটা দেশের বাস্তব অবস্থা স্বচক্ষে না দেখতে পেলেও যেহেতু উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সঙ্গে আজ অনেক বছর যুক্ত, তাই আমাদের রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতি প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করি। শিক্ষাকে যদি একটি ‘সোনালী চতুর্ভুজ’ বলা হয় তাহলে তার চারটি বাহুতে দাঁড়িয়ে আছে যথাক্রমে—শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবকবৃন্দ ও মাননীয় সরকার বাহাদুর। এদের কেউই শিক্ষার এই অন্তর্জলী যাত্রার জন্য নিজেদের দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না, এ কথা ঠিক। তবে, আমার মতে সবচেয়ে বেশী দায় সরকারকেই নিতে হবে। কারণ, পাশ-ফেল প্রথা তুলে দিয়ে প্রারম্ভিক শিক্ষাটাকে ধ্বংস করেছেন মাননীয় সরকার বাহাদুরই।
বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর যা সরাসরি প্রত্যক্ষ করলে যে কোন সংবেদনশীল মানুষের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবেই। প্রাথমিকে পাঁচটি বছর পড়ার পরেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী বর্ণ পরিচয়হীন হয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছে। এখানে এসেও তাদের মানের উন্নয়ন ঘটানো খুবই কঠিন। কারণ, তাদের ভিত চরম দুর্বল এবং সেই সঙ্গে পরীক্ষায় পাশ ফেলের কোন ভীতি নেই। তারা জানে যে পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠা মানেই নবম শ্রেণিতে ওঠা। অধিকাংশ বিদ্যালয় আবার শিক্ষার্থীর চাপ সামলাতে না পারার কারণে নবম শ্রেণিতেও নিম্ন মানের ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষায় ফেল করানোর দুঃসাহস দেখায় না। বলা বাহুল্য, এমন অনেক স্কুল শিক্ষার্থী আছে যারা জীবনের প্রথম পাশ-ফেলের পরীক্ষা যেটা দিচ্ছে তার নাম মাধ্যমিক। পাশ ফেল তুলে দিয়ে সরকার বিদ্যালয় ছুট কমাতে চাইলেন। হয়তো কিছুটা কমেওছে, কিন্তু বিদ্যালয়ে নানা প্রলোভনে আটকে রাখা ছাড়া আর কি কিছু হচ্ছে? পাশ-ফেল তুলে দিতে গেলে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার আগে তাদের কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছে দিতে হবে। সেই মানে তাদের কিছুমাত্র পৌঁছে না দিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করলে তাদের আগের শ্রেণির শিখন অসম্পূর্ণ থাকে এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি শ্রেণিতে পিছিয়ে পড়তে পড়তে অষ্টম শ্রেণির প্রারম্ভিক শিক্ষার শেষে দেখা যাচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীটি কিছুই শেখেনি।
আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো এই পাশ-ফেল উঠে যাওয়ার ফলে পরীক্ষা একটা নিছক ছেলেখেলায় পরিণত হয়েছে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে। কারণ, তারা জানে যে পরের শ্রেণিতে তাদের উত্তরণকে কেউ আটকাতে পারবে না। পরের শ্রেণিতে পাশ করিয়ে তুলতে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যেভাবে খাতা দেখতে হচ্ছে এবং তারপর ‘বাংলার শিক্ষা পোর্টাল’-এ নম্বর তুলতে হচ্ছে সেই ইতিহাস না হয় প্রকারান্তরে অন্য দিন বলা যাবে। এসবের ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে ‘মূল্যবোধ’ অপসৃত হচ্ছে। তাদের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবমাননা করার প্রবণতা তৈরী হচ্ছে— ‘এ মাষ্টার আমার আর কী করতে পারে’ জাতীয়। বিদ্যালয়ের সম্পত্তি, ফুলের বাগান ইত্যাদির ক্ষতি করা, বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাকে পাত্তা না দিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে স্কুলে ঢোকা, এমনকি শ্রেণিকক্ষেও তা বের করা— এই জাতীয় শৃঙ্খলাহীনতার মধ্যে পড়ে। স্কুল ক্যাম্পাসের ভিতর সেল্ফি তোলা, অশ্লীল ভিডিও দেখা এসবও শৃঙ্খলাহীনতার আরো জ্বলন্ত উদাহরণ।
ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক ঘোষণা করেছে— আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে কেন্দ্র সরকার পোষিত এবং কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ-ফেল প্রথা ফেরানো হচ্ছে। যে সমস্ত শিক্ষার্থী প্রথমে বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে না, তাদেরকে আবার শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ নতুন করে প্রস্তুত করিয়ে দু’মাস পরে আবার বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেবেন। এইখানেই হয়ে গেল ভাবের ঘরে চুরি। এই দায়িত্বটা কি শিক্ষক-শিক্ষিকারা সত্যি করে নিতে পারবেন? নাকি কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছে না দিতে পেরে ঐসব শিক্ষার্থীদের নাম-কা-ওয়াস্তে একটা পরীক্ষা নিয়ে বেশী বেশী নম্বর পাইয়ে দিয়ে পরের শ্রেণিতে তুলে দেবেন? কারণ, কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছে দিতে না পারলে সেটা তাদেরও ব্যর্থতা। তাই, ঐ দু’মাস পরে ফেল করিয়ে আগের শ্রেণিতে রেখে দেওয়ার ঝামেলা আর কে নেয়! তাছাড়া, কেন্দ্র ও রাজ্য কোন সরকারেরই শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে কোন সদিচ্ছা নেই। দুই সরকারেরই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রচুর শিক্ষক ঘাটতি। আর পাশ ফেল চালু করে শিক্ষার যথার্থ মানোন্নয়ন ঘটাতে গেলে শুধু পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণিতে পাশ-ফেল প্রথা চালু করলেই হবে না, চালু করতে হবে প্রাথমিকের শুরু থেকেই। এখন এসবের থেকেও বড় কথা হলো, কেন্দ্র তো যা হোক করতে চাইছে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে কী হবে? শিক্ষা যেহেতু ভারতীয় সংবিধানের যৌথ তালিকার (Concurrent List) অন্তর্ভুক্ত। তাই শিক্ষা সংক্রান্ত কেন্দ্রের যে কোন প্রস্তাব রাজ্যে বাস্তবায়িত করতে হলে, রাজ্য সরকারের অনুমোদন দরকার। পাশ-ফেল সংক্রান্ত কেন্দ্রের নতুন প্রস্তাবে যদি রাজ্য সরকার সায় না দেয়, তাহলে রাজ্যের স্কুলগুলোতে কোনদিনই পাশ-ফেল চালু হবে না। এখন পর্যন্ত যা মনে হয় তাতে রাজ্যের বর্তমান শাসক দল কোয়ালিটি এডুকেশন চাই না। চাই কোয়ান্টিটি। তাই খাতায় কলমে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে রাজ্যের শিক্ষার মানোন্নয়ন দেখাতে, মিড-ডে মিল সহ নানারকম সরকারী প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা ছাত্র-ছাত্রীদের এবং উপরের দিকে অসাধু ব্যবসায়ী, নেতা-মন্ত্রীদের বেশী বেশী করে পাইয়ে দিতে রাজ্য সরকার পাশ ফেল চালু করার দিকে যাবে না। প্রশ্ন তুলবে বেশী ড্রপ আউট হয়ে রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক অবক্ষয় হবে। আসলেই ভোটের রাজনীতি ঠিকঠাক করতে হলে ‘নো ডিটেনশন’ চালু রেখে রাজ্যের মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখতে পারলেই লাভ বেশী।
পরিশেষে বলবো আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশের শিক্ষা নিয়ে গবেষণা যদি উন্নত দেশগুলোর নিরিখে করা হয়, সেটা বিরাট ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। তাই, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের আর্থ সামাজিক পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এবং তাদের জন্য কোয়ান্টিটি নয় কোয়ালিটি এডুকেশন সুনিশ্চিত করতে গেলে, দ্রুত প্রাথমিক স্তর থেকেই আবার পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনা উচিত।
(সংগৃহীত, মতামত লেখকের নিজস্ব)