১০০ দিনের কাজ বন্ধ, কেন্দ্রের পদক্ষেপ সম্পূর্ণ অন্যায়: সরব সামাজিক সংগঠনগুলি

শেয়ার করুন

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা: বিগত তিন বছর ধরে এমজিএনআরইজিএ তথা ১০০ দিনের কাজ বন্ধ থাকায় বাংলার লক্ষাধিক শ্রমজীবী মানুষ অর্থসঙ্কটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দুর্নীতির অভিযোগে ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। গত ৯ মার্চ, ২০২২ থেকে এমজিএনআরইজিএ আইনের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাজ্য সরকার কৃত কথিত দুর্নীতির অভিযোগের কারণে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ তহবিল বন্ধ আছে। এর ফলে গ্রামীণ শ্রমিকরা কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতি ও বঞ্চনা নিয়েই মোদি সরকারকে আক্রমণ শানাল একাধিক সামাজিক সংগঠন। বৃহস্পতিবার কলকাতা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে সংগঠনের নেতৃত্বরা বললেন, “কেন্দ্রের তহবিল বন্ধের সিদ্ধান্তের ফলে অগণিত পরিবার বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। অনেকে চরম পদক্ষেপ নিয়ে আত্মহত্যাও করেছে।” কেন্দ্র সরকার কি আদৌ এমজিএনআরইজিএ আইনটি বহাল রাখতে চাইছে? তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংগঠনগুলি।

সমাজকর্মী প্রশান্ত বসাক বলেন, এমজিএনআরইজিএ আইনের ২৭ নম্বর ধারায় কেন্দ্রীয় সরকারকে শুধুমাত্র একটি ‘যুক্তিসঙ্গত সময়ের’ জন্য তহবিল বন্ধ করার ক্ষমতা দিয়েছে। তিন বছর ধরে একনাগাড়ে বলবৎ থাকা এই স্থগিতাদেশ প্রশ্ন তুলছে, কেন্দ্র সরকার কি আদৌ ১০০ দিনের কাজের আইনটি বহাল রাখতে চাইছে? ২৭ নম্বর ধারায় আরও স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ রয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারেরও তহবিল স্থানান্তর পুনরায় শুরু করার সময় ‘যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাগুলি রূপায়ন’ করার কথা। এখনও পর্যন্ত নিম্নবর্ণিত যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার প্রয়োগ নেই এবং কার্যকরীও নয়।

তাঁর মতে, পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেত মজুর সমিতি বনাম ভারতের ইউনিয়ন এবং অন্যান্য মামলায় (WPA (p) 237 of 2022) রাজ্য সরকার দাবি করেছে, ১৯ জুন ২০১৯ থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এর মধ্যে ১৯টি অ্যাকশন টেকন রিপোর্টের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছে, ২০২২-এর জুলাই-আগস্ট মাসে ১৫টি কেন্দ্রীয় দলের পরিদর্শনের পরে বড় সমস্যাগুলি সনাক্ত করা হয়েছিল এবং বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছিল। হাইকোর্টে বা অন্য কোথাও প্রকাশ্যে পাওয়া অসঙ্গতিগুলি উল্লেখ করা হয়নি।

খেত মজুর সমিতির সদস্য অম্বরিশ সোরেন তথ্য দিয়ে বলেছেন, ১৮ জানুয়ারী ২০২৪-এ, রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় দল দ্বারা পুনরুদ্ধারের জন্য সুপারিশকৃত ৬১৩.১৪ লক্ষের মধ্যে ২১০.৩৫ লক্ষ পুনরুদ্ধার করেছে বলে দাবি করেছে। হাইকোর্ট ১৮ জানুয়ারী ২০২৪-এ কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের ৪ জন প্রতিনিধি নিয়ে দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করার জন্য একটি বিশেষ দল গঠনের আদেশ দেয়, ৩ মাস পরে, ১৮ এপ্রিল তার গঠন নিশ্চিত করে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।

সমাজকর্মী দীপ্যমান অধিকারীর বক্তব্য, ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর পিপলস রাইট টু ইনফরমেশন (এনসিপিআরআই) দ্বারা দায়ের করা আরটিআই-এর উত্তরে, কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে যে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল, ২০২২-এর মধ্যে তারা ৬৩টি কাজের সাইট পরিদর্শন করেছে, সেগুলির মধ্যে ৩২টি কাজের সাইট সন্তোষজনক এবং ৩১টিতে গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। কয়েকটি ব্যাতিক্রমী মামলা বাদে, সরাসরি দায়ী আধিকারিকদের উপর আইনি ব্যবস্থা বা জরিমানা আরোপ করা হয়নি। যেমন জেলা শাসক এমজিএনআরইজিএ আইন অনুযায়ী, ১০০ দিনের কাজের জেলা প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর) এবং ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার (আইন অনুযায়ী যিনি প্রোগ্রাম অফিসার) বা পঞ্চায়েত কর্মচারীরা, যারা সবাই উল্লিখিত আইনের অধীনে সরাসরি দায়ী।

পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেত মজুর সমিতি, শ্রমজীবী মহিলা সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র-যুব সংগ্রামী মঞ্চ, ভুখা মানুষের অধিকার মঞ্চ, সেওয়া বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গ চা মজুর সমিতির নেতৃত্বরা সাফ জানিয়েছেন, “আসলে সবটাই হচ্ছে পদ্ধতিগত ব্যর্থতা, কিন্তু তার বোঝা সম্পূর্ণভাবে নিরীহ শ্রমিকদের উপর পড়েছে। যাদের প্রত্যেকের এই তিন বছরে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।”

 

কর্মশ্রী প্রকল্প: মিথ এবং বাস্তবতা

কর্মশ্রী প্রকল্পের অধীনে পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে নিশ্চিত কর্মসংস্থান প্রদানের রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছে সংগঠনগুলি। এটি একটি রাজ্য স্তরের কর্মসংস্থান প্রকল্প যা এমজিএনআরইজিএ তথা ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের জব কার্ড হোল্ডারদের জন্য বছরে ৫০ দিনের কাজ প্রদান করবে। এটিকে একটি আইনে পরিণত করার অভিপ্রায় এর সাথে যুক্ত। এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের তহবিল বন্ধ রাখার কারণে মানুষের ভোগান্তি দূর করতে। যদিও এই প্রকল্পটির সাফল্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইতিমধ্যেই বিভ্রান্তি দেখা গিয়েছে।

>প্রকল্পটি ৭ মার্চ ২০২৪-এ ঘোষণা করা হয়েছিল এবং তা অবিলম্বে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হল এর জন্য কোনও বাজেট বরাদ্দ করা হয়নি।

>কয়েক মাস পরে বিধানসভায় অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্য সরকার ২০২৩-২৪ এর জন্য ৮২৯৭ কোটি টাকা প্রদান করছে যাতে ৭৩.৯৫ লক্ষ সক্রিয় জব কার্ড হোল্ডারদের ৩৯ কোটি কর্ম দিবস দেওয়া হয়। কর্ম দিবস পিছু ২১২ টাকা, যা ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের তুলনায় যথেষ্ট কম, ফলত কর্মশ্রী প্রকল্পের সম্ভাব্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা গিয়েছে।

>৩ ডিসেম্বর ২০২৪-এ দিল্লিতে নারেগা সংঘর্ষ মোর্চা এবং অন্যান্য মঞ্চ দ্বারা আয়োজিত সাংসদ এবং রাজনৈতিক দলগুলির জন্য একটি ব্রিফিংয়ে, রাজ্যসভার সদস্য দোলা সেন এবং লোকসভার সদস্য মহুয়া মৈত্র উভয়ই তৃণমূল কংগ্রেসের, বলেছেন, যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকল্পটিকে আইনে পরিণত করার পরিকল্পনা করছে। ডোলা সেন জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভা ইতিমধ্যেই এটি অনুমোদন করেছে।

>এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেত মজুর সমিতির সদস্য ৫ হাজারের বেশি শ্রমিক ৬টি জেলায় কাজের জন্য আবেদন করেও কেউই কাজ পাননি। তৃণমূল স্তরের এই শ্রমিকরা কাজ পাওয়ার জন্য মরিয়া, তাদের আবেদনগুলি হয় সরাসরি বিডিও অফিসে জমা দেওয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তা প্রত্যাখ্যান করা হয় বা কোন কোন ক্ষেত্রে কোন উত্তর দেওয়া হয় না।

>এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্পর্কে জনসাধারণের জন্য প্রদত্ত তথ্য শুধুমাত্র রাজ্য সরকারের কর্মশ্রী ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। এই পোর্টালটিতে ২৫টি অর্থায়ন বিভাগের মোট সংখ্যা দেখানো হয়, যেখানে মোট ৪১৮৪টি প্রকল্প রয়েছে, যার মোট প্রকল্প ব্যয় ১৩.১৩ কোটি টাকা। তবে রহস্যজনকভাবে ব্যয় করা তহবিলের পরিমাণ শূন্য এবং শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ১৪১।

>প্রকল্পটির নির্দেশিকা এবং বাস্তবায়ন দেখে মনে হচ্ছে, যে কর্মশ্রী যা করেছে তা হল যে ঠিকাদাররা যারা শ্রমিক নিয়োগ করত তাদের এখন তাদের মাস্টার রোলে শ্রমিকদের চাকরির কার্ড তালিকাভুক্ত করাতে জোর দেওয়া হচ্ছে। কোনো নতুন কাজ তৈরি হচ্ছে না এবং কোনো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।

 

অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান:

কৈন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়কেই বাংলার গ্রামীণ শ্রমিকদের এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সামাজিক সংগঠনগুলি।

১। কেন্দ্রীয় সরকারকে অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজের-এর জন্য তহবিল ছেড়ে দিতে হবে।

২। ৫০ দিনের কাজকে একটি গ্যারান্টিযুক্ত অধিকারে পরিণত করতে রাজ্য সরকারকে অবশ্যই একটি আইন পাস করতে হবে যা কর্মশ্রীকে একটি আইনে পরিণত করবে

৩। রাজ্য সরকারকে অবশ্যই কর্মশ্রী প্রকল্পে কাজের জন্য আবেদনগুলি গ্রহণ করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদনের উত্তর দিতে হবে।

৪। এই অবস্থার জন্য দায়ী দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে, ভুক্তভোগী গ্রামীণ শ্রমিকদের অবিলম্বে ১০০ দিনের কাজ ও কর্মশ্রী প্রকল্পের অধীনে কাজ দিতে হবে।

খেত মজুর সমিতির সভাপতি উত্তম কুমার গায়েন দাবি করেছেন, এ পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা থেকে কেন্দ্রীয় একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গ্রামীণ শ্রমিকদের সমস্যার কথা তুলে ধরেছি। গায়েন  বলেন, “১০০ দিনের কাজে যারা দুর্নীতি করেছে তাদের শাস্তি না দিয়ে, ভুক্তভোগী গ্রামীণ শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্র-রাজ্য উভয়েই বাংলার গ্রামীণ শ্রমিকদের এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ নিক। পাশাপাশি রাজ্যের জন্য ১০০ দিনের কাজের তহবিল ছাড়ুক কেন্দ্র। গ্রামীণ শ্রমিকেরা প্রধানমন্ত্রীকে আবেদনপত্রের সঙ্গে ১ টাকা করে মানিঅর্ডার পাঠিয়েছেন তাঁদের করুণ অবস্থার প্রতি নজর দেওয়ার জন্যে।”

সমাজকর্মী অনুরাধা তলোয়ার কেন্দ্রকে নিশানা করে বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কাজে দুর্নীতি নিয়ে অনেক তদন্ত করেছে, কিন্তু তারা শক্ত কোনও দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি। তাহলে কেনো ৩ বছর ধরে ৭৫ লক্ষ শ্রমিককের কাজ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তাঁর আরও বক্তব্য, “যারা ১০০ দিনের কাজের উপর নির্ভরশীল, তারা কাজ না পেয়ে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। রাজ্যের শ্রমিকরা কাজ না পাওয়ার জন্য একমাত্র দায়ী বঙ্গ বিজেপি। কারণ, কেন্দ্র ১০০ দিনের কাজ শুরু করতে চাইলেও বঙ্গ বিজেপি তাতে বাঁধা দিচ্ছে। তাদের ঘৃণ্য রাজনীতির জন্য ৭৫ লক্ষ শ্রমিক বঞ্চিত হচ্ছে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *