মানিক ফকির
লেখক বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও প্রাবন্ধিক
সম্প্রীতি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলাকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদীদের ‘আঁতুড়ঘর’ প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে, বাংলা ও বাঙালির সর্বনাশ করতে চাইছে কেন্দ্রের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার। মূলত হিন্দু-মুসলমান বিভাজন এবং সেই বিভাজনকে তীব্র করে দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যেতে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতে চাইছে তারা। সে কারণেই ভুঁড়ি ভুঁড়ি মিথ্যা ও কুৎসাকে হাতিয়ার করেছে বিজেপি। এক শ্রেনীর পেটোয়া মিডিয়ার সাহায্যে। বলতে দ্বিধা নেই বাংলার বহু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বাঙালির ধারণা হয়েছে, বাঙালি বিরোধী বিজেপির চক্রান্তে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মুর্শিদাবাদ পুলিশের একটি অংশ। যা হয়তো জেনেও জানেন না অথবা বুঝেও বোঝেন না রাজ্য সরকারের পুলিশ প্রশাসনের মাথারা। ফলে ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের আক্রমণের মূল শিকার মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন দরিদ্র মুসলিম পরিবার, মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন মাদ্রাসা, মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত বিভিন্ন মওলানা ও হাফেজগণ। ইতিহাস বলছে, একদা বাম আমলে বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মাদ্রাসাগুলোকে জঙ্গিদের আঁতুড়ঘর বলে ফেলে, বাম সরকারের ভয়াবহ বিপদ ডেকে এনেছিলেন। অথচ সিপিএম পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম দু’জন যথা কমরেড মুজাফফর আহমদ এবং কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাদ্রাসাতেই লেখাপড়া শিখেছিলেন। এমনকি বিশ্বের অন্যতম মহামানব সমাজ বিপ্লবী হরি গুরু চাঁদ ঠাকুর পিতা-পুত্র উভয়েই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। এক কথায় বিশ্বের সমস্ত মুসলিমেরই সাংঘাতিক ভাবে আবেগ জড়িয়ে থাকে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি।
সম্প্রতি ১৬ নভেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গায় কার্তিক লড়াই (উৎসব) এর প্যান্ডেলে লাইটিংকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়। যদিও পুলিশ বাহিনীর তৎপরতায় সে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে পারেনি বেশি দূর। কিন্তু কলকাতার বেশ কয়েকটি ‘গোদি মিডিয়া’ সারা ভারতে প্রচার করে দেয়, মুর্শিদাবাদের মুসলমানরা সনাতনী হিন্দুদের পুজোতে বাধা দেয় ও আক্রমন করে। মুহূর্তের মধ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সেই কুৎসা ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। পরবর্তী সময় জানা যায়, সেই দাঙ্গার পিছনে মাস্টার মাইন্ড ছিলেন মুর্শিদাবাদ ভারত সেবা সংঘের সংগঠক কার্তিক মহারাজ, রাজ্যের বিরোধী দল নেতা অর্থাৎ বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রমূখ। যদিও এই ঘটনায় সরাসরি যুক্ত বলে গ্রেফতার হন সায়ন হালদার নামে একজন ছাত্র। পরিতাপের বিষয় এটাই, বেলডাঙ্গা দাঙ্গার ঘটনার অপরাধীরা ধরা পড়লেও বাংলার ‘গোদি মিডিয়া’ এনিয়ে কোনো খবর করেনি।
কিন্তু মারাত্মক ঘটনা হচ্ছে, বেলডাঙায় ১৬ তারিখের ঘটনার পরে ১৭ তারিখ, ঘটনার কিছুটা দূরে কাহার পাড়ার একটি মন্দিরের চাতালে রাত্রি বেলায় বেশ কয়েকটা অস্ত্র ফেলে রেখে ছবি তুলে নেয় বেলডাঙ্গা থানার জনৈক অফিসারের নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ। এ ঘটনা দেখতে পেয়ে গ্রামের মেয়েরা হাতে নাতে ধরে ফেলে একজন সিভিক ভলেন্টিয়ারকে। তাঁকে মারধর করে ধরে রাখে। প্রথমে বাকি পুলিশরা পালিয়ে যায়। পরে কয়েকজন পুলিশ এসে সিভিক ছেলেটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলা বন্দী মুক্তি কমিটির পক্ষে তায়দুল ইসলাম ঘটনার বিবরণ দিয়ে বিচার চেয়ে আবেদন করে জেলার পুলিশ সুপারের কাছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে ঘটনা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি জেলা পুলিশ দপ্তর ও রাজ্যের বৃহৎ মিডিয়া গোষ্ঠী গুলি।
সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের হরিহর পাড়া ও নওদা থেকে জঙ্গি তকমা দিয়ে বেশ কয়েকজন দরিদ্র মুসলিম ধর্মাবলম্বীকে, গ্রেফতার করে তুলে নিয়ে যায় আসাম পুলিশ। ফলে গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলাকে নাকি দখল নিয়েছে সন্ত্রাসবাদীরা। যদিও এর ফলে আইনের চোখে অনুপ্রবেশকারী হিন্দু উদ্বাস্তুদের গ্রেফতার করা কিছুটা সুবিধা হয়ে যায় ভারতের স্বরাষ্ট্র রাষ্ট্রের কাছে। কারণ, গত ১৯৯৮ সালে ১৩ মাসের বিজেপি সরকারের সময় থেকেই বিজেপি নানা ভাবে মিথ্যা তত্ত্ব ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল এই বলে যে, হিন্দুরা শরণার্থী আর মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী। অথচ আজ পর্যন্ত ভারতে এমন কোনো আইন নেই। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। দেশের সরকার মুসলমানদের জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদী, বলে যতো চিৎকার করছে, হিন্দু অনুপ্রবেশকারীরা ততো আনন্দে বগল বাজাচ্ছে ও গ্রেফতার হচ্ছে।
এই মুহূর্তে ভারতের উত্তরপ্রদেশে, মধ্যপ্রদেশ, আসাম, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র সহ বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে বৈদেশিক আইনের ১৪ ধারায় মামলা দায়ের করছে বিজেপি সরকার। ফলে এই মানুষগুলোর আর কোনো সুযোগ নেই ভারতে নাগরিক হয়ে বসবাস করার। ইতিমধ্যে মহারাষ্ট্র থেকে বহু অর্থবান বাংলাদেশি ঘর বাড়ি ফেলে ভারত ছাড়া হচ্ছে নানা উপায়ে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের ঘটনা অন্য। বরং বলা যেতে পারে হিন্দু উদ্বাস্তুদের ধরতেই হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার বাংলার মুসলমানদের দাবার গুটি বানিয়েছে। নীতিগত ভাবে যা তারা কখনোই করতে পারে না। এটা ভয়ংকর অপরাধ।
সম্প্রতি কলকাতার কয়েকজন সত্যসন্ধানী ইউটিউব চ্যানেলের সাংবাদিকদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছিলাম সদ্য গ্রেফতার হাওয়া জঙ্গিদের সম্পর্কে তথ্য সন্ধান করতে। পৌঁছে গিয়েছিলাম, হিন্দুত্ববাদীদের সাহায্যপুষ্ট বিভিন্ন গোদি মিডিয়ায় প্রচারিত জঙ্গিদের ‘আঁতুড়ঘর’ সলুয়া মাদ্রাসায়। বোঝা গেলো এই মাদাসার ছাত্র-ছাত্রী ও সহজ সরল মানুষ গুলো অনেকেই জানেন না ‘জঙ্গি’ জিনিসটি কি। কতিপয় ‘গোদি মিডিয়া’ প্রচার করেছে এই মাদ্রাসারই মাস্টার ছিলেন সন্ত্রাসবাদী মওলানা আব্বাস আলী। বাস্তবে আব্বাস এই মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন দু’বছর আগে। বর্তমানে সে তার নিজের বাড়ি বোরহান গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে একটি আনকমপ্লিট বাড়ি ভাড়া নিয়ে টিউশনি করতেন। হাফেজ আব্বাস ১০ জন শিশুকে আরবী বর্ণপরিচয় শেখাতেন। তার বংশের কেউ কোনো দিন বাংলাদেশ যাননি। তার বাবা ও মায়ের পূর্ব পুরুষগণ যুগ যুগ ধরে খন্ডিত ভারতের সন্তান। তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেলো হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান আব্বাস কখনোই রাজ্যের বাইরে যায়নি। নিতান্তই সাধারণ মানুষ আব্বাস। ধর্ম ভীরু আব্বাসের স্বপ্ন ছিল সে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করবে। যেহেতু ভারতের মুসলিমদের মধ্যে আরব দুনিয়ায় চাকরি করতে যাওয়ার প্রবণতা থাকে, তাই আব্বাসের ও একটি পাসপোর্ট আছে। যেটি আইন সম্মত। নকল নয়। তার এক ভাই পরিযায়ী শ্রমিক।
মিডিয়া আব্বাসের টিউশনি ঘরের ছবির সঙ্গে সলুয়া মাদ্রাসার ছবি যুক্ত করে প্রচার করে দেয়, সে বাংলাদেশি সন্ত্রাসবাদী ও নকল পাসপোর্টের কারবারি। আসাম এসটিএফের হাতে গ্রেফতার হওয়া অন্যজন হচ্ছেন, হরিহরপাড়া থানার মাগুরা গ্রামের মিনারুল শেখ। সেও ভারতের প্রকৃত নাগরিক। একটু বোকা সোকা চাষী মানুষ। তার নিজের একাউন্টটা ছিল একশো দিনের কাজের টাকা ঢোকার জন্য। অথচ গদি মিডিয়া প্রচার করে দেয়, এদের দু’জনেরই একাউন্ট থেকে নাকি কোটি কোটি টাকা লেন দেন হয়। এরা দু’জনই অনুপ্রবেশকারী ও ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদী। ফলত হিসাব অনুযায়ী গ্রেফতারের পর দুজনের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করা হয়েছে ইউএপিএ (UAPA) ও পাসপোর্ট ফরেন এ্যাক্টের মতো ভয়ংকর আইনগুলো। যদিও পাসপোর্ট ও ফরেনার্স অ্যাক্ট লাগু হয় কেবল মাত্র বিদেশিদের জন্য। তথাপি মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র এই দুই অসহায় মুসলিম সন্তানকে অনুপ্রবেশকারী সন্ত্রাসবাদী সাজিয়ে তাদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালাচ্ছে আসামের এসটিএফ। যা শুধু বেআইনিই নয়, চরম মানবতা বিরোধী।
অথচ এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে মুর্শিদাবাদ জেলার নিমতিতা স্টেশনের রেললাইনে বোম রাখতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে যায় সাগর দাস ও মদন দাস নামে দু’জন হিন্দু সনাতনী সন্ত্রাসবাদী। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। কিন্তু পুলিশের কৌশলে এক দিনের মধ্যেই তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী সাগর আর মদন দু’জনকেই জামিন দিতে বাধ্য হয় আদালত। আশ্চর্যজনক ভাবে এক্ষেত্রে ইউএপিএ-এর মতো ভয়ংকর কোনো আইন প্রয়োগ হয়নি এই দুই সনাতনী সন্ত্রাসবাদীর বিরুদ্ধে। হয়তো শুধুমাত্র ধর্মের কারণেই, হিন্দু বলে। বলতে দ্বিধা নেই, এ ঘটনা বাংলার মুসলিম সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে সাংঘাতিক ভাবে। যদিও আজও বহু মুসলিম আশা করেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী তাদের প্রতি কোনো অন্যায় হতে দেবেন না। তিনি নিশ্চয় এই মারাত্মক অন্যায়ের সঠিক বিচার করবেন। এবং আব্বাস-মিনারুলদের মতো অসহায় পরিবার গুলোর পাশে দাঁড়াবেন ও সঠিক বিচার পেতে সাহায্য করবে। এখন দেখা যাক।
(মতামত লেখকের নিজস্ব।)