গাজা: গাজায় ইসরাইলি হামলায় প্রতিদিন নিহত হচ্ছে সাধারণ নাগরিকরা। বর্বরোচিত হামলার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না নিষ্পাপ শিশুরাও। গাজা ভূখণ্ডে অমানবিক ও বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়ার মত একাধিক ঘটনা সামনে এসেছে। এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
গত বছর যুদ্ধের শুরুতে যায়নবাদিদের হামলায় নিহত হন একাধিক শিশু। তার মধ্যে ছিল খালেদ নাভান নামের এক ফিলিস্তিনির নাতনি। ইসরাইলি হামলায় ৩ বছর বয়সী নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যুর খবরে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। নাতনি রিমের দেহ দেখতে পেয়ে ছুটে যান দাদজি। নাতনির ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহকে জড়িয়ে ধরে চোখে চুম্বন করেন পিতামহ। সঙ্গে বলেছিলেন, “আমার আত্মার আত্মা” আমায় ছেড়ে চলে গেল। ওইদিনই পাঁচ বছর বয়সী নাতি তারেকও নিহত হয়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলি ঢালাও করে তা তুলে ধরে। এই ঘটনাকে ইসরাইলি হামলার ‘বেদনাদায়ক’ প্রতীক হিসাবে দেখা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়েছিলেন খালেদ নাভান।
নাতনি রিমের মৃত্যুর পর থেকে আহত ফিলিস্তিনিদের সহায়তায় নিজেকে নিয়োজিত করেন নাভান। বিশেষত ইসরাইলি হামলায় আহত শিশুদের যত্ন নিতে উদ্ধারকারী এবং চিকিৎসক দলের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। ফিলিস্তিনিদের ‘ত্রাতা’ খালেদ নাভানকে এবার হত্যা করল খুনি ইসরাইল। তিনি ‘আবু দিয়া’ নামেও পরিচিত। সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) গাজার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নুসেইরাত শরণার্থী শিবির লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায় ইসরাইল। সেই হামলাতেই নিহত হন খালেদ নাভান ওরফে আবু দিয়া। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার নাতনি রিম ও নাতি তারেক নিহত হন। ২০২৪ সালে নিহত হলেন তিনি।
ফিলিস্তিনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, সোমবার খালেদ নাভানের বাড়ি লক্ষ্য করে হামলা করে ইসরাইলি সেনারা। সেই হামলায় নাভান ও এক শিশুসহ অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। এদিকে ফিলিস্তিনের মানবাধিকার কর্মীরা নাভানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। গাজার লেখক ও বিশ্লেষক মুহাম্মদ শেহাদা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে লিখেছেন, “তারা (ইসরাইল) প্রথমে তার নাতনিকে হত্যা করেছে। তারপর তার পরিবারের বাড়িতে বোমা হামলা করেছে। এখন প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে হত্যা করা হল।” গাজার লেখক বলেন, “ইসরাইল তার নাতনিকে হত্যা করার পর, তিনি এক বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ভালোবাসা ও আশার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। অভাবী মানুষদের সাহায্য করেছেন, ক্ষুধার্ত শিশু ও বিড়াল ছানাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন এবং তার মায়ের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেছেন।”
নাভানের হত্যা নিয়ে ইসরাইলের তীব্র সমালোচনা করেছেন ফিলিস্তিনি-আমেরিকান ধর্মপ্রচারক ও অ্যাক্টিভিস্ট ওমর সুলেইমান। এক্স-এ তিনি লিখেছেন, “সর্বত দেবদূতের মতো উপস্থিতি ছিল মানুষটির। গণহত্যার পরিস্থিতির মধ্যেও তার মুখে হাসি ছিল, তার যন্ত্রণা সত্ত্বেও মানুষকে সাহায্য করতে হাসপাতালে এবং শরণার্থী শিবিরগুলিতে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন।” সুলেইমানের কথায়, “আমি সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম, কবে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরব এবং তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করব। আমি কল্পনা করেছিলাম যেদিন যুদ্ধ শেষ হবে, তারপর তাকে পুরস্কৃত করব। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে শয়তান বাহিনী নাভানকে হত্যা করেছে।”
সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) পর্যন্ত গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৪৫ হাজার ছাড়িয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানানো হয়েছে, গত ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া এই যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৫ হাজার ২৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এছাড়া আরও এক লাখ ৬ হাজার ৯৬২ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৫২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ সময় আরও কমপক্ষে ২০৩ জন আহত হয়েছে। অনেক ফিলিস্তিনি রয়েছেন, যারা ধ্বংস্তুপের নিচেই রয়ে গেছেন। তারা হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। তাদের সংখ্যা যোগ করা হলে নিহতের সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। এদিকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনকে গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করেছে রাষ্ট্রসংঘের বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি। ফিলিস্তিনি জনগণকে আংশিক ও পুরোপুরি ধ্বংস করার একটি প্রচেষ্টা বলেও বর্ণনা করে রাষ্ট্রসংঘ।
সূত্র: আল জাজিরা