সম্প্রীতির ঐতিহ্যে উজ্জ্বল মুর্শিদাবাদ

শেয়ার করুন
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার

             লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 

পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলী জিন্নাহ ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট দিনেই শুরু হয়েছিল লড়াই। দিনটি ছিল ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট। সাম্প্রদায়িক লড়াই বা দাঙ্গা মানেই বস্তুত গৃহযুদ্ধ। সেই গৃহযুদ্ধে রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিল রাজধানী কলকাতার রাজপথে। কয়েকদিন ধরে চলা সেই প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের পরিণামে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় সাড়ে চার হাজার হিন্দু-মুসলমান। শারীরিকভাবে আহত হয়েছিলেন ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। মানসিক আঘাত অপরিমেয়। সেই বীভৎস গৃহযুদ্ধে গৃহহীন হয়ে পড়েছিলেন দশ হাজারের বেশি মানুষ। আলোকপ্রাপ্ত কলকাতার সেই অন্ধকারময় সময়টিকে ইতিহাস মনে রেখেছে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে। কিছুকালের মধ্যেই সেই ভাতৃঘাতী দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী থেকে শুরু করে ওদিকে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি সহ বিভিন্ন স্থানে। সেই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিনেও মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ ছিল শান্ত, সুসংহত। এখানে সম্প্রীতির বন্ধন এতটাই দৃঢ়। এই জেলাতে বসেই আজীবন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের নিরলস সংগ্রাম চালিয়েছেন প্রবাদ প্রতিম মানুষ অধ্যাপক রেজাউল করিম। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকেরা তাদের শোষণের স্বার্থে ধর্মীয় বিভেদের যে প্রাচীর তুলে দিয়েছিল তাকে ভেঙে ফেলাই ছিল মহর্ষি রেজাউল করিমের সারা জীবনের সাধনা। স্বাধীনতাপূর্ব উত্তেজক সময়ে এ জেলায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সমর্থনে সর্বদা সক্রিয় ছিলেন আব্দুস সামাদ, ব্রজভূষণ গুপ্ত, বিজয়কুমার ঘোষাল, শশাঙ্কশেখর সান্যাল, বিজয়কুমার গুপ্ত, সৈয়দ বদরুদ্দোজা সহ আরও বহু বিশিষ্টজন।

 

‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র ধাক্কায় সারা দেশ যখন টালমাটাল তখন মুর্শিদাবাদের নবাববাহাদুর ওয়াসিফ আলী মির্জা (১৮৭৫ – ১৯৫৯) ‘হিন্দু-মুসলমান অধিবাসীগণের প্রতি’ আবেদন জানিয়ে একটি বার্তা প্রচার করেন। তাতে বলা হয় — “আজ আমি মুর্শিদাবাদবাসী হিন্দু-মুসলমানকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতেছি যে তাহারা সর্বধর্ম নিষিদ্ধ পরস্পরকে ভীতি প্রদর্শন হইতে সর্বদা বিরত থাকিবেন। ঘৃণ্য ও দুষ্টবুদ্ধি প্রণোদিত উত্তেজনায় অযথা উত্তেজিত হইয়া শান্তি-শৃঙ্খলা বিসর্জন দিয়া কদাচ কেহ যেন কোনরূপ হিংসাত্মক নৃশংস কর্মের দ্বারা নিজেকে বা নিজ সম্প্রদায়কে কলুষিত না করেন; পড়ন্তু তাহারা সকলেই যেন পরস্পর পরস্পরের প্রতি আন্তরিকভাবে আস্থাপন্ন থাকিয়া ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় রাখেন। ইহাই আমার পুণ্যস্মৃতি পূতচরিত্র মহীয়ান পূর্বপুরুষগণের চিরাচরিত শান্তি ও শৃঙ্খলার সহিত জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রজাপালনের জীবন্ত আদর্শ। আমি তাঁহাদিগকে আমার আন্তরিক নির্দেশ জানাইতেছি যে, উভয় সম্প্রদায় প্রকৃত একতার সূত্রে আবদ্ধ হইয়া বাংলার তথা ভারতের অবশ্যম্ভাবী কল্যাণের পথে অগ্রসর হউন।”

 

১৯৪৭ সালে অবহেলায় আঁকা র‍্যাডক্লিপের রাজনৈতিক মানচিত্র অনুযায়ী মুর্শিদাবাদ ঢুকে গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে। যাদের অক্লান্ত চেষ্টায় তিনদিন পর, ১৮ আগস্ট, মুর্শিদাবাদের ভারতভুক্তি সম্ভব হয়, তাদের অন্যতম ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উদারমনা ধর্মনিরপেক্ষ মননের মানুষ নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জা। তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সমিতি’। তাঁর উদ্যোগেই ১৯৩৭ সালে হাজারদুয়ারি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় দুদিনের এক ঐতিহাসিক ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সম্মেলন’। তাতে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় দশ হাজার সাধারণ হিন্দু-মুসলমান। সেই বছরই বহরমপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজের কুমার হোস্টেলের মাঠে মুসলিম লীগের রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন মহম্মদ আলী জিন্নাহ স্বয়ং। প্রসঙ্গত, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হলেও মুর্শিদাবাদ জেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে ওই দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯২৭ সালে অর্থাৎ দু’দশকেরও বেশি পরে। কোনও ধর্মীয় মৌলবাদই, স্বাধীনতার আগে ও পরে, এ জেলার নির্বাচনী রাজনীতিতে বিশেষ পাত্তা করতে পারেনি। ১৯৩৭ সালে ‘মুর্শিদাবাদ সাধারণ’ কেন্দ্রে হিন্দুমহাসভা সমর্থিত নির্দল প্রার্থী রায়বাহাদুর সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহকে পরাস্ত করেন কংগ্রেস প্রার্থী শশাঙ্ক শেখর সান্যাল। শ্রীসান্যাল ছিলেন নেতাজির ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মুসলিম মৌলবাদের অবস্থাও ছিল তথৈবচ।

 

স্বাধীনোত্তর দেশে ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত চারটি বিধানসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ জেলায় একটিও আসন জিততে পারেনি মুসলিম লীগ। ১৯৭১ সালে প্রথম তারা এই জেলায় চারটি আসনে জয়ী হয়। সেই বিধানসভা ভেঙে যাওয়ায় ফের ১৯৭২ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেবারে মুসলিম লীগ পায় একটি মাত্র আসন। তার পরের আর কোনও নির্বাচনে কোনও আসনে জিততে পারেনি মুসলিম লীগ। তারা শেষবারের মতো নিছক নির্বাচনী স্বার্থে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অস্ত্রে শান দিতে সচেষ্ট হয় ১৯৮৮ সালের ২৪ জুন। সরকার অধিগৃহীত স্থানে আইনত ধর্মাচরণ করা যায় না জেনেও প্রায় ২৫ হাজার সরলবিশ্বাসী সাধারণ মুসলিমকে নিয়ে কাটরা মসজিদে নামাজ পড়ার ডাক দেয়। সেই ঘটনায় প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও হিন্দু মৌলবাদের প্ররোচনায় অন্তত ২৪ জন নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়। তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন ছিলেন ঘটনার সাথে সম্পূর্ণভাবে সংশ্রবহীন। ২ জুলাই দৌলতাবাদ হাইস্কুলের অতীব সজ্জন শিক্ষক সৈয়ব আলীর পচাগলা লাশ পাওয়া যায় বানজেটিয়ায় একটি পায়খানার চেম্বার থেকে। বহরমপুরের পুষ্পলাল এবং কুমড়াদহ ঘাটের মাখনলাল বিশ্বাসের লাশ গায়েব হয়ে যায় চিরতরে। মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাসে সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা।

 

আবারও এই জেলাকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাঁদমারি করে তোলার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। বেলডাঙার অপ্রীতিকর ঘটনা সেই ইঙ্গিতই করছে। স্মরণ করা যেতে পারে, কয়েক বছর আগে হিন্দুত্ববাদীরা লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ভোজপুরি সিনেমার হিংসা-দৃশ্যকে বসিরহাটের দাঙ্গাচিত্র বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিল। সম্প্রতি এই রাজ্যের শাসক দলের এক প্রাক্তন মন্ত্রী জেলার ‘৩০ শতাংশ হিন্দুকে কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার’ হুংকার দিয়েছেন প্রকাশ্যে। তবু তিনি বেকসুর! তার পাল্টা দিয়ে স্বয়ং সিএম-এর সাথে বিতন্ডায় জড়িয়েছেন এক গেরুয়াধারী ‘মহারাজ’। আবার দুই হুমকিবাজকে একই বিজয়া সম্মিলনীর মঞ্চে হাত মেলাতেও দেখা গেছে! তাহলে বেলডাঙার ঘটনার সাথে কি বৃহত্তর নির্বাচনী মেরুকরণের কোনো সংযোগ রয়েছে? সুখ ও স্বস্তির কথা, হিন্দু-মুসলিম কোন সম্প্রদায়ই আপাতত প্ররোচনার ফাঁদে পা দেননি।

 

(মতামত লেখকের নিজস্ব।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *