সিরিয়ায় বাসাল আল আসাদ সরকারের পতন ও দেশত্যাগের পর বিদ্রোহী গোষ্ঠি একের পর এক জেলবন্দিদের মুক্ত করেছে। জেলগুলি যে প্রকৃত অর্থেই ছিল ‘মানব কসাইখানা’ তা উঠে এসেছে কয়েকজন জেলবন্দির কথায়।
সংবাদ হেডলাইন, ওয়েবডেস্ক: সিরিয়ার বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের মধ্য দিয়ে আসাদ পরিবারের অর্ধ শতাব্দীর শাসনের পতন হয়েছে। ব্যক্তিগত একটি উড়োজাহাজে দামেস্ক ছেড়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। তিনি ২৪ বছর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে বিদ্রোহীদের হামলায় সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের কারাগার থেকে হাজার হাজার বন্দি মুক্তি পেয়েছেন। তাদের মধ্যের একজন হলেন হালা। কারা মুক্তির পর জেলের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন তিনি। হালার কথায়, “আমার নাম ছিল ১১০০ নম্বর।” আল জাজিরাকে মহিলা বলেছেন, তাকে ২০১৯ সালে হামার একটি চেকপয়েন্ট থেকে ‘সন্ত্রাসবাদের’ অভিযোগে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাকে আলেপ্পোতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি বিভিন্ন কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। হালার অভিযোগ, সরকারের বিরোধিতা করায় দেশের নাগরিকদের ‘সন্ত্রাসবাদের’ অভিযোগে প্রায়শই তুলে নিয়ে যাওয়া হত। বিদ্রোহীরা সিরিয়া দখলের পর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অসংখ্য বন্দিকে মুক্ত করে। এ প্রসঙ্গে হালা বলেন, “আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি ফের আলো দেখতে পাব।” বিদ্রোহীদের প্রশংসা করে তাঁর বক্তব্য, এইচটিএস-এর বিদ্রোহীরা যখন দামেস্ক দখল করে তখন আনন্দ ছিল অপরিসীম। আমরা জয়ল্লাস করেছি। ইচ্ছে করছিল আমরা মুক্তিদাতাদের জড়িয়ে ধরে যদি চুম্বন করতে পারতাম। তাঁর কথায়, “আমি যখন আমার পরিবারের কাছে ফিরে এলাম তখন আনন্দ ছিল দ্বিগুণ। মনে হচ্ছিল যেন আমি আবার জন্ম নিয়েছি।”
সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস অনুসারে, বিদ্রোহীদের দেশ দখলের আগে সিরিয়ার নৃশংস কারাগারে বন্দি থাকা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৪ জনের মধ্যে হালা ছিলেন একজন। সিরিয়ার কারাগারগুলির ভয়াবহ নির্যাতনের ভয়ে দেশের মানুষ আসাদ সরকারের সমর্থনের মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করত। ২০১৩ সালে কারাগারের ভয়াবহ নির্যাতনের বেশকিছু ছবি হাতে পায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি জানিয়েছিল, “সিরিয়ার সরকারি বন্দি শিবিরগুলিতে ব্যাপক নির্যাতন, অনাহার, মারধর ও রোগব্যাধির অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল।”
জেলবন্দী অবস্থায় থাকাকালীন হালা দেখেছিলেন, ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসে বর্বোরোচিত নির্যাতন চালানো হয়। হালা বলেন, মেয়েটিকে তার বিয়ের মাত্র দুই মাস পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার সঙ্গে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, এক বয়স্ক মহিলা এবং দু’জন ডাক্তারকেও গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। আসাদ পুলিশের অভিযোগ ছিল, ধৃতরা বিদ্রোহীদের সাহায্য ও চিকিৎসা করেছিল।
সিরিয়ার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন মাহের। যিনি তার পুরো নাম প্রকাশ করতে চাননি। তিনিও ভয়াবহ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ২০১৭ সালে ‘সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের’ অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় মহিলাকে। বিনা বিচারে গত সাত বছর ধরে সিরিয়ার কারাগারে বন্দি ছিলেন তিনি। মাহের বলেছেন, “বন্দি জীবনে তাঁকে মানুষই মনে করা হয়নি। আর পাঁচটি বন্দির মত তিনিও ছিলেন কেবলমাত্র একটি সংখ্যা।” কারাগারের ভয়াবহতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, “নির্যাতনের তীব্রতা এবং অত্যাচারের পাশবিক পদ্ধতি এমনটাই ছিল যে, প্রতি মিনিটে যেন মৃত্যুর দিকে ঢোলে পড়ছিলাম। যে ধরণের নির্যাতন ও অত্যাচার করা হত তা একটি প্রাণীও সহ্য করতে পারবে না।” তবে তার কাছে সবচেয়ে মর্মান্তিক মুহূর্ত ছিল, যখন তিনি দামেস্কের কুখ্যাত মেজ্জেহ কারাগারে একজন আত্মীয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বছরের পর বছর নির্যাতনের পর তিনি যে জেল থেকে মুক্তি পাবেন তা ভাবতেই পারেননি মাহের। তাঁর কথায়, আলেপ্পোর কারাগার থেকে বের হওয়ার কথা তিনি কখনোই ভাবেননি। জেল মুক্তির দিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “যখন গুলির শব্দ কারাগারের কাছাকাছি চলে আসে, আমরা সবাই ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি শ্লোগান দিতে শুরু করি। আমরা কখনই বিশ্বাস করতে পারিনি যে জেলমুক্তির স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। আমরা কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে বিপ্লবীদের আলিঙ্গন করি। কৃতজ্ঞতায় আল্লাহুর কাছে সিজদা করি। ইদলিবে পরিবারের সঙ্গে বসবাসকারী আমার বোনের বাড়িতে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমাদের নিরাপদে রাখা হয়।”
৪৯ বছর বয়সী বৃদ্ধ সাফি আল-ইয়াসিনকেও আলেপ্পোর কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। আলেপ্পোর জেলে কাটানো দিনগুলির ‘স্মৃতি মুছে ফেলা যায় না’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। বৃদ্ধ বলেন, জেলমুক্তি আমার কাছে নতুন জন্মের দিনের মতো, মনে হচ্ছে আমার জীবনের এটি প্রথম দিন। আল জাজিরাকে তিনি জানান, ‘এই আনন্দ অবর্ণনীয়।’
জেল জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, সেখানে প্রায় ৫ হাজার বন্দি ছিল। যখন আমরা বুঝতে পারি বিদ্রোহীরা কারাগারের কাছাকাছি চলে এসেছে, তখন আমরা জানালা ভাঙতে শুরু করি। এরপর দরজা ভেঙে বের হতে শুরু করি। এমনকি কারাগারের অফিসার ও রক্ষীরাও বেসামরিক পোশাক পরে আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল। যাতে তারা বিদ্রোহীদের হাতে ধরা না পড়ে।
আল-ইয়াসিন পেশায় একজন কামার ছিলেন। তিনি আটকের আগে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় শহর বানিয়াসে মাছ ধরার নৌকা তৈরি করতেন। আল-ইয়াসিন জানান, ২০১১ সালে সিরীয় বিপ্লবের শুরুতে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া একটি বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর থেকে জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় কারাদণ্ডেই পার করেছেন তিনি। ঊনপঞ্চাশের বৃদ্ধ বলেন, জেলবন্দির পর থেকে ১৪ বছর ধরে সিরিয়ার বিভিন্ন কারাগারে তাকে মারাত্মক শারীরিক ও বছরের পর বছর মানসিক নির্যাতন করা হয়।
আলেপ্পোর কারাগারে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে সায়দনায়ার কুখ্যাত কারাগারে এক বছর কাটিয়েছিলেন আল-ইয়াসিন। ২০১৭ সালে সায়দনায়ার কারাগারকে ‘মানব কসাইখানা’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। কারাগারের ভয়াবহতা নিয়ে আল-ইয়াসিন জানান, “এক বৃদ্ধকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। তার গোটা শরীর রক্তে ভিজে গেছিল। পরে বৃদ্ধ মারা গিয়েছিলেন। আমি যে দৃশ্য দেখেছি তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার স্মৃতি থেকে মুছবে না।”
(সূত্র: আলজাজিরা)