বিশেষ সংবাদদাতা: ছোটখাটো বিষয় নিয়ে দাম্পত্যজীবনে হামেশাই ঝামেলা হয়ে থাকে। প্রবাদ রয়েছে, যত বেশি ঝগড়া, তত বেশি ভালবাসা। তাই ঝগড়া-অভিমান ভুলে ফের একে অপরের মধ্যে প্রেম-ভালবাসা খুঁজে পাওয়াই একটি সম্পর্কের মূলধন। তবে বর্তমানে এই ছোটখাটো বিষয়গুলিই যখন আরও বড় আকার ধারণ করে, তখন দাম্পত্যজীবনে কলহ শুরু হয়। ছোট ছোট সমস্যাকে ঘিরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রোজকার অশান্তি বাড়তেই থাকে। খুলতে থাকে বৈবাহিক সম্পর্কের বাঁধন। দূরত্ব বেড়ে এমন পর্যায়ে চলে যায়, বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। সম্প্রতি এমনই এক দাম্পত্যজীবনের অশান্তি নামিয়ে আনে মর্মান্তিক পরিণতি।
সূত্রের খবর, বেঙ্গালুরুর একটি আবাসন থেকে প্রযুক্তি কর্মী অতুল সুভাষের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সঙ্গে উদ্ধার হয় ২৪ পাতার একটি সুইসাইড নোট। যেখানে স্ত্রী নিকিতা সিংহানিয়া, শাশুড়ি নিশা সিংহানিয়া, শ্যালক অনুরাগ-সহ স্ত্রীর পরিবারের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ করেছেন বত্রিশ বছর বয়সী যুবক। প্রতিটি পাতায় লেখা, ‘বিচার এখনও বাকি!’ মৃত্যুর আগে ৮০ মিনিটের একটি ভিডিও রেকর্ড করেন অতুল। সেখানে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘বিচার না মেলা পর্যন্ত তোমরা যেন আমার অস্থি বিসর্জন কোরো না!’ দাবি, স্ত্রী এবং শ্বশুরবাড়ির অন্যরা অতুলের বিরুদ্ধে একাধিক ‘মিথ্যে’ অভিযোগ করেছিলেন। এরপর পারিবারিক আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের মামলার রায় যুবকের বিপক্ষেই গিয়েছিল।
মনে করা হচ্ছে, সেই চাপের মুখেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন যুবক। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর গোটা দেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে ৪৯৮এ ধারার অপব্যবহার এবং খোরপোশের অধিকার নিয়ে। জানা গিয়েছে, যদিও অতুলের স্ত্রী বড় চাকরি করেন, তবুও মামলার জেরে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা খোরপোশ দিতে হত। অতুলের দাবি ছিল, নিকিতা মাসে ২ লক্ষ টাকা খোরপোশ চেয়েছিলেন তাঁর ও তাঁদের চার বছরের পুত্রের জন্য। ২০২০ সাল থেকেই এই নিয়ে তিনি ও তাঁর মা-ভাই লাগাতার চাপ দিয়ে আসছিলেন বলেই সুইসাইড নোটে অভিযোগ করেছেন অতুল। বেঙ্গালুরুর যুবকের আত্মহত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়েছে তাঁর স্ত্রী। পাশাপাশি তাঁর মা নিশা সিংহানিয়া ও ভাই অনুরাগ সিংহানিয়াকেও আটক করেছে পুলিশ। অভিযোগ ছিল, অতুলের স্ত্রী নিকিতা সিংহানিয়ার দায়ের করা বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়েই নিজেকে শেষ করে দেন অতুল। এই নিয়ে শুরু হয়েছিল বিতর্ক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলিতে বিবাহবিচ্ছেদ অতি সাধারণ বিষয় হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজে বিবাহকে পবিত্র হিসেবে দেখা হয়। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ভারতেও উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ। দাম্পত্যজীবনের টানাপোড়েন সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। হাই-প্রোফাইল পরিবারগুলিতেও বিবাহবিচ্ছেদ মাত্রারিক্ত ভাবে বাড়ছে। কেনো সমাজে এত বৈবাহিক সমস্যা ও বিচ্ছেদের মত ঘটনা ঘটছে। তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। বছরের পর বছর ধরে বিবাহবিচ্ছেদের মামলার সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে দেশে, যা চিন্তার।
সাম্প্রতিক সরকারী এক তথ্য বলছে, ১.৩৬ মিলিয়নেরও বেশি ভারতীয় বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে যা মোট জনসংখ্যার ০.১১%। এছাড়া তালাকপ্রাপ্ত মহিলার সংখ্যা পুরুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। যেখানে ৪ লাখ ৫২ হাজার পুরুষের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে, সেখানে তালাকপ্রাপ্ত মহিলার সংখ্যা ৯ লাখ ৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আরও অবাক করা বিষয় হলো, বিয়ের পর আলাদা থাকেন এমন সংখ্যা তালাকপ্রাপ্ত সংখ্যার চেয়ে তিনগুণ বেশি ছিল। ৩৫ লাখের বেশি স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকেন না। দাম্পত্যজীবনে অশান্তির কারণে তারা আলাদা থাকেন। ৩৫ লাখের মধ্যে প্রায় ২৪ লাখ মহিলা তাদের স্বামীদের থেকে আলাদা থাকেন। ২০০১ সালের জনগণনা তথ্য অনুযায়ী, ৩.৩৩ মিলিয়নেরও বেশি দম্পতি তালাকপ্রাপ্ত এবং অশান্তির কারণে আলাদা বসবাস করছে। ২০১১ সালের মধ্যে, এই সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৫ মিলিয়নেরও বেশি। সরকারি তথ্যই বলছে দেশজুড়ে উল্লেখযোগ্য হারে বিবাহবিচ্ছেদ মত ঘটনা ঘটছে।
এদেশে বিবাহবিচ্ছেদ বা দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সংক্রান্ত মামলা পারিবারিক আদালতে সমাধান করা হয়। সরকারী তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে আট শতাধিক পারিবারিক আদালত রয়েছে। এই আদালতগুলিতে বিবাহবিচ্ছেদ, খোরপোষ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পত্তি বিরোধ এবং শিশু কার কাছে থাকবে এই বিষয়গুলি সমাধান করে। পরিসংখ্যান বলছে, পারিবারিক আদালতে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০২৩ সালের শেষে প্রায় ১১ লাখ ৫০ হাজার মামলা বিচারাধীন ছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্র লোকসভায় পারিবারিক আদালতে দায়ের ও নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে। সেই তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সারা দেশের পারিবারিক আদালতগুলিতে ৮ লাখ ২৬ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করেছে। অথাৎ প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার ২৬৫টি মামলা। এর অর্থ হল, প্রতিদিন গড়ে ৯৪টি বিবাহবিচ্ছেদ বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ সম্পর্কিত মামলা সমাধান করা হয়েছিল। ২০২২ সালে বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত ৭ লাখ ৪৪ হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
এদিকে বিশ্বব্যাংক এবং ওইসিডি-এর রিপোর্ট বলছে, পর্তুগালে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ৯২ শতাংশ। যা গোটা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। ইউরোপীয় দেশগুলিতে সাধারণত বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিবাহ বিচ্ছেদের নিরিখে ১৯ তম স্থানে রয়েছে। সেখানে বিবাহবিচ্ছেদের হার ৪৫% শতাংশ। ভারতে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা এবং দাম্পত্যজীবনে অশান্তি বাড়লেও বিবাহবিচ্ছেদের হার বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন। ভারতে বিবাহবিচ্ছেদের হার মাত্র ১ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০০ বিয়ের মধ্যে একটি বিবাহবিচ্ছেদ হয়।