দাবি আদায়ে জীবন বাজি

শেয়ার করুন

চণ্ডীগড়: এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অনশনে কৃষক নেতা জগজিৎ সিং দালেওয়াল। ক্রমশ ভেঙে পড়ছে শরীর। অথচ চিকিৎসাগ্রহণে নারাজ পাঞ্জাবের কৃষক নেতা। শেষে হস্তক্ষেপ করতে হয় সুপ্রিম কোর্টকে। যেভাবেই হোক ওই কৃষক নেতাকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি করতে নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। তারপরেও দালেওয়ালকে চিকিৎসা গ্রহণে রাজি করানো যায়নি। প্রথম থেকেই ধালেওয়াল দ্বৈত কন্ঠে বলে আসছেন, কেন্দ্র আলোচনায় বসলে তবেই চিকিৎসা গ্রহণ করবেন তিনি। এখনও পর্যন্ত তাঁর অবস্থান থেকে কিঞ্চিৎ নড়েননি কৃষক নেতা।

আন্দোলনরত কৃষকদের সমস্যা সমাধান করতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে উচ্চ পর্যায়ের এক কমিটি গঠন করে সুপ্রিম কোর্ট। সেই কমিটির শীর্ষ পদে রাখা হয় হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নবাব সিংকে। সোমবার (৬ জানুয়ারি) কমিটির প্রতিনিধিরা কৃষক নেতা দালেওয়ালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা কৃষক নেতাকে চিকিৎসা গ্রহণের আবেদন জানান। কিন্তু তিনি সাফ জানান, ‘নো’। পাঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্তের খানৌরিতে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার প্রধান দালেওয়াল অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন করছেন। এদিন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কৃষক নেতাকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিচারপতি নবাব সিং জানান, “শুনানির প্রতিটি দিনে তিনি (সুপ্রিম বিচারপতি সূর্যকান্ত) আপনার সুস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করতে নির্দেশিকা জারি করতে থাকেন।”

বিচারপতির কথা শুনে দালেওয়াল বলেন, কেন্দ্রকে আলোচনায় বসতে নির্দেশ দিক সুপ্রিম কোর্ট। অনশনরত কৃষক নেতার বক্তব্য, “আমি বিচারপতি সূর্যকান্ত জিকে শ্রদ্ধা করি। আমাদের সমস্যা সমাধান করতে পারে একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু আমি কীভাবে বিচারপতিকে জিজ্ঞেস করব, তিনি কেন কেন্দ্রকে কোনও নির্দেশ দিচ্ছেন না? পাঞ্জাবের অ্যাডভোকেট জেনারেল যখন কেন্দ্রকে নির্দেশ দিতে বলেন, তখন সূর্যকান্তজি শোনেন না।” দালেওয়ালের কথায়, “সুপ্রিম কোর্ট যদি কেন্দ্রীয় সরকারকে এই নির্দেশ না দেয়, তবে আমাদের একমাত্র ভরসার জায়গা শেষ হয়ে যাবে।” তাঁর সাফ কথা, কেন্দ্র কৃষকদের দাবি মানলে তবেই অনশন উঠবে।

প্রসঙ্গত, মোদি সরকারের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে দেশের কৃষকরা। তাদের আন্দোলনের জেরে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে পাঞ্জাব সীমান্ত। সেখানে আমরণ অনশনে রয়েছেন কৃষক নেতা জগজিত সিং দালেওয়াল। শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষক নেতা আমৃত্যু অনশন চালাচ্ছেন। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অনশন করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। কেন অনশনরত দালেওয়ালের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে পাঞ্জাব সরকার হাসপাতাল ভর্তি করছে না, তা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে পাঞ্জাব সরকারের একটি দল কৃষক নেতার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আর্জি জানানো সত্ত্বেও তিনি কোনওরকম চিকিৎসা নিতে রাজি হননি। যদিও আন্দোলনকারী কৃষকদের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টকে জানানো হয়, কেন্দ্র আলোচনায় রাজি থাকলে তবেই দালেওয়াল চিকিৎসা নেবেন।

বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছিল, দালেওয়ালকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে, যাতে তাঁর জীবন বিপন্ন না হয়। চিকিৎসার মধ্যে থেকেই প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে তাঁর কোনও আইনি বাধা নেই। বিচারপতি সূর্যকান্ত বলেন, ‘কৃষক নেতা হিসেবে দালেওয়ালের জীবন খুব দামি। তিনি কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী নন। তিনি শুধুমাত্র কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য লড়ছেন।’ পাঞ্জাবের অ্যাডভোকেট জেনারেল গুরমিন্দর সিংকে সুপ্রিম বিচারপতি বলেন, ‘আপনার আমলা বা মন্ত্রীরা তো একবারও অনশন মঞ্চে যাননি। আপনারা সমঝোতা চান বলে তো মনে হয় না।’

কৃষকদের তরফে যে ৫ দফা দাবি তোলা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, পুরনো ভূমি অধিগ্রহণ আইনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ১০ শতাংশ প্লট এবং ৬৪.৭ শতাংশ বর্ধিত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ১ জানুয়ারি, ২০১৪ সালের পর অধিগ্রহণ করা জমির জন্য বাজারমূল্যের চার গুণ ক্ষতিপূরণ এবং ২০ শতাংশ প্লট দিতে হবে। এর পাশাপাশি সকল ভূমিহীন ও ভূমিহীন কৃষকের সন্তানদেরও কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের সুবিধা দিতে হবে। এবং সর্বোপরি আইন এনে এমএসপির গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে হবে। সেই দাবি আদায়েই অনশনে ওই কৃষক নেতা। চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার খানাউরি সীমানায় অবস্থানে রয়েছেন কৃষকরা। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা-সহ একাধিক দাবি রয়েছে তাঁদের। কৃষক নেতা অভিমন্যু কোহার বলেন, ‘অবস্থানের প্রথম দিন থেকেই আমাদের দাবিগুলি অত্যন্ত স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও আমাদের আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। একটা ধারণা তৈরি করা হচ্ছে, কৃষকরা জেদি। কিন্তু কেন্দ্রই নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে কৃষকদের কোনও দাবিতেই আমল দিচ্ছে না।’ তাঁর সংযোজন, ‘আমরা গান্ধীবাদী নীতিতে চলব। এ বার সরকারের উপর নির্ভর করছে যে তারা অনশনরত জগজিৎ সিং দালেওয়ালের উপর জোরজুলুম করবে, না তাঁর দাবিগুলি শুনে উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে। উনি নিজের জীবন বাজি রেখে কৃষকদের দাবি আদায়ের জন্য আমরণ অনশন করছেন। সাধারণ মানুষ আমাদের পাশে রয়েছে। এ বার কেন্দ্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কী করবে।’

অন্যদিকে, পাঁচ দফা দাবিতে ফের পথে নামার ডাক দিয়েছে কৃষকরা। আবারও সাধারণতন্ত্র দিবসে রাজধানী দিল্লির জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা। আগামী একমাসে দেশজুড়েই একাধিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন কৃষকরা। দেশের অন্নদাতাদের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামী ১৩ জানুয়ারি দেশের গ্রামে গ্রামে নতুন কৃষি নীতির খসড়া পোড়াবেন কৃষকরা। দেশজুড়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে। ২৬ জানুয়ারি অর্থাৎ সাধারণতন্ত্র দিবসে দেশজুড়ে ট্রাক্টর মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কৃষকদের সংগঠন সংযুক্ত কিষান মোর্চা (অরাজনৈতিক)। ওইদিন ফের পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা রাজধানী দিল্লিতে প্রবেশ করতে পারেন।

কে এই কৃষকনেতা দালেওয়াল?

৭০ বছর বয়সী জগজিৎ সিং দালেওয়াল পাঞ্জাবের বাসিন্দা। রাজ্যটি কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাপকভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে সেখানে কৃষি আয় ধারাবাহিকভাবে কমছে। এমন পরিস্থিতি কৃষকদের ঋণের জালে ফেলার পাশাপাশি আত্মহত্যা এবং অভিবাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অনশনরত দালেওয়াল একটি কৃষক সংগঠনের নেতা। সংযুক্ত কৃষক মোর্চার সঙ্গে তার এই সংগঠনের কিছুটা যোগ রয়েছে। কৃষক মোর্চা কয়েক ডজন ইউনিয়নের একটি জোট। এই জোট ২০২০ সালের আন্দোলন সমন্বয় করেছিল। তিনি এর আগে পাঞ্জাবে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন এবং আত্মহত্যা করা কৃষকদের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি করেন।

২০১৮ সালে তিনি দিল্লির দিকে আন্দোলনরত কৃষকদের ট্রাক্টরের একটি বহরের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আন্দোলনে ২০০৪ সালের একটি সরকারি প্যানেলের সুপারিশ অনুযায়ী কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের জন্য লাভজনক মূল্য এবং কৃষি ঋণ মওকুফের দাবি জানানো হয়েছিল। গত নভেম্বরে অনশন শুরুর আগে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দালেওয়ালকে হাসপাতালে নেয় রাজ্য পুলিশ। তবে তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই বিক্ষোভে ফিরে আসেন। তখন তিনি দাবি করেন, তাকে হাসপাতালে আটকে রাখা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি চিঠিতে দালেওয়াল লেখেন, তিনি কৃষকদের মৃত্যুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ‘নিজের জীবন উৎসর্গ’ করতে প্রস্তুত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *