সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরীক্ষাগার মুর্শিদাবাদ

শেয়ার করুন

আব্দুল হালিম বিশ্বাস (শিক্ষক)

এদেশে মন্দির মসজিদ বিতর্ক, দাঙ্গা হাঙ্গামা অশান্তি, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বহুল পরীক্ষিত পদ্ধতি। পদ্ধতির মূলে রয়েছে গণিতের ৮০:২০ অনুপাত। সস্তা ও সহজ উপায়। মানুষকে ধর্মের নামে বিভক্ত করে দিলেই ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যাওয়ার নিশ্চিত সিঁড়ি। তাই বাবরি মসজিদ ও রাম জন্মভূমি বিতর্কে বিজেপির পর্বত তুল্য সাফল্য দেখে ছোট বড়ো অনেক নেতানেত্রী এখন অনুপ্রাণিত।

সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের বাস মুর্শিদাবাদ জেলা ইতিমধ্যেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। গত লোকসভা নির্বাচনে তার অনুশীলন গঙ্গাপারে সকলে দেখেছে। “এক ঘন্টায় জেলার ৩০ শতাংশ হিন্দুকে কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে পারি” বলে একজন বিধায়কের হুঙ্কারে বহরমপুর সংসদীয় কেন্দ্রের ভোটের হিসাব কতখানি উলোট পালোট হয়ে যায়, কংগ্রেস প্রার্থী অধীর রঞ্জন চৌধুরী সবচেয়ে বেশি জানে। এটাই বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের বাস্তবতা। কত সস্তা ও সহজ উপায়। সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কৃষি শিল্প স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও বিকাশের কোনো উদ্যোগ নেই। দ্রব্যমূল্য, বেকারত্বের মতো জ্বলন্ত সমস্যার কোনো সমাধান নেই। বড় কথা কোনো প্রয়োজন নেই। ধর্মের নামে একটি কাঠি জ্বালিয়ে দিলেই ব্যস! বিরোধীরা সব সাফ।

“বেলডাঙ্গায় বাবরি মসজিদ হবে” এমন উলঙ্গ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চিন্তা চেতনাহীন নেতানেত্রীদের পক্ষেই সম্ভব। বেলডাঙ্গার অদূরেই শিল্পতালুকের জন্য নির্দিষ্ট প্রাচীর ঘেরা কয়েক শত একর জমি হাহাকার করছে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা শিল্প কারখানার অপেক্ষায়। না, নেতানেত্রীদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁদের চায় সস্তা ও সহজ উপায়। মুর্শিদাবাদ জেলার মুসলমান সমাজে নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও ভূমিহীন পরিবারে আর শিক্ষা নেই। ধর্মীয় উন্মাদনার কানাগলিতে পথ হারিয়েছে তারা। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকদের এটাই উর্বর ক্ষেত্র। তাই তো ধর্মীয় জলসা মঞ্চে যখন ঘোষণা হয়, “বেলডাঙ্গায় বাবরি মসজিদ হবে”, লক্ষ কন্ঠে ধ্বনি উঠে “আল্লাহু আকবার”। এই সকল বর্তমান কুটিল ও জটিল ভারতীয় রাজনীতির বিন্দু বিসর্গ জ্ঞানহীন মানুষেরা জানে না বিপরীতে এই জেলায় ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক রাজনীতি দানা বেঁধেছে। বিজেপি ও আরএসএস মুর্শিদাবাদ জেলার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসেছে।

Read More: সম্প্রীতির ঐতিহ্যে উজ্জ্বল মুর্শিদাবাদ

গত বছর সংসদে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলা এবং ঝাড়খণ্ডের আরারিয়া, কাটিহার ও কিষানগঞ্জ, মুসলমান জনবহুল পাঁচটি জেলা নিয়ে পৃথক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল গঠনের ও এনআরসি করার দাবি জানায়। নিছক একটা দাবি নয়। মুর্শিদাবাদের বিজেপি বিধায়ক গৌরি শঙ্কর ঘোষের নেতৃত্বে বহরমপুর শহরে এই দাবির সমর্থনে দুটি বৃহৎ মিছিল হয়। ভাষণে বলা হয়, পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ থেকে জেলায় অজস্র ধারায় অনুপ্রবেশ ঘটছে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। জেলার জন বিন্যাসে ভারসাম্য হারিয়ে গেছে যা ভারতবর্ষের সার্বভৌম ও নিরাপত্তার জন্য বিপদজনক। অবিলম্বে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ে কেন্দ্র সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা যে আগামী নির্বাচনে বিষয়টি বিজেপির দলীয় এজেন্ডা হতে পারে। ভারতের গোদী মিডিয়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবেদনের পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ জেলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করছে। তাদের বিশ্লেষণ, বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে চীনের আধিপত্য বাড়ছে। ফলে চীন বাংলাদেশ হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলায় পৌঁছে যাবে যা ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্য বিপজ্জনক।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলাম ও হেফাজতে ইসলামের মতো মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। ইতিমধ্যে ইউনুস সরকার বহু জঙ্গিকে মুক্তি দিয়েছে। জঙ্গি সন্ত্রাস বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনুমান করে মুর্শিদাবাদ জেলাকে পাখির চোখ করেছে বিজেপি ও আরএসএস। ফলে অনুমান করা যায়, আগামী দিনে মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগ্যাকাশে দূর্যোগের ঘন কালো মেঘ ক্রমে ঘনীভূত হতে যাচ্ছে। তারই মধ্যে বাবরি মসজিদ নির্মাণের সস্তা রাজনীতি জেলাবাসীর বিপন্নতা বৃদ্ধি করবে। যত বেশি ধর্মীয় উন্মাদনা বাড়বে, কেন্দ্রীয় সরকারের কশাঘাত তত বেশি নেমে আসবে। এই সহজ কথাটি জেলার মুসলমান সমাজকে বুঝতে হবে।

আগত বিপন্নতা থেকে মুক্তির একটিই পথ, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে জেলাবাসীর মধ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ, পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহবস্থান। এই উদ্যোগ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে। সাংস্কৃতিক চর্চাই পারে মানুষের সঙ্গে মানুষকে মেলাতে। আমাদের সাংস্কৃতিক পথেই হাঁটতে হবে, অন্তত আগামী প্রজন্মের জন্য। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারিগরদের সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে হবে আমরা শান্তিপূর্ণ মুর্শিদাবাদ জেলায় আর একটি মণিপুর চাই না। আমাদের জেলার ঐতিহ্য ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভালোবাসার। আমরা জেলাবাসী মিলেমিশে এক হয়ে থাকতে চাই।

(সংগৃহীত। মতামত লেখকের নিজস্ব।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *